আফ্রিকা মূলত অন্ধকার দেশ। অথচ সেই আফ্রিকা ক্রমাগত উজ্জ্বল হচ্ছে। যেসব দেশে বাল্যবিবাহের প্রকোপ অত্যন্ত বেশী তার মধ্যে জাম্বিয়া অন্যতম। এই দেশটিতে মেয়েদেরকে অল্প বয়সে বিয়ে দেয়া শুধু তাদের সংস্কৃতির অংশই নয়, বরং আর্থিক সমৃদ্ধির একটি উপায়ও বটে।
এমন কুসংস্কারে আচ্ছন্ন আফ্রিকার সব দেশের মতো জাম্বিয়াও। তবুও হাজার বছরের সংস্কৃতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অনেকেই জেগে উঠছেন অন্ধকারের বিপরীতে। সেই এক দেশের নাম জাম্বিয়া। মানচিত্রের আজকের আয়োজন জাম্বিয়াকে ঘিরেই।
জাম্বিয়া আফ্রিকা মহাদেশের পূর্বাঞ্চলের একটি রাষ্ট্র। সবুজ বন-বনানী আর বাঘে মহিষে এক ঘাটে জল খেয়ে বেড়াবার এই দেশ। এই দেশকে বলা যায় জিরাফেরও দেশ।
পাখির অভয়ারণ্য বলেও আলাদা কদর আছে। জাম্বিয়ার রাজধানীর নাম লুসাকা। দেশটির উত্তরে কঙ্গো ও তানজানিয়া, পূর্বে মালাউয়ি, দক্ষিণ-পূর্বে মোজাম্বিক, দক্ষিণে জিম্বাবুয়ে, বোতসওয়ানা ও নামিবিয়ার কাপ্রিভি, পশ্চিমে অ্যাঙ্গোলা। দেশটির আয়তন ৭৫২,৬১৪ বর্গকিমি।
জাম্বিয়ার লোকজনের প্রধান ভাষা ইংরেজি। স্থানীয় পঁয়ত্রিশটি ভাষা প্রচলিত থাকলেও এদের মধ্যে বেম্বা ভাষাতে প্রায় এক-চতুর্থাংশ লোক কথা বলে।
অন্যান্য ভাষার মধ্যে টোঙ্গা ভাষা এবং নিয়াঞ্জা ভাষা উল্লেখযোগ্য। ফানাগালো নামের একটি ভাষা-ভিত্তিক পিজিন ভাষা শহর এবং খনি এলাকগুলিতে সার্বজনীন ভাষা হিসেবে সুপ্রচলিত। সেতলা নামের আরেকটি পিজিন ভাষা আছে, যার ভিত্তি সোয়াহিলি ভাষা। আন্তর্জাতিক কাজকর্মেও তাদের প্রধান ভাষা ইংরেজিই ব্যবহার করা হয়।
প্রতিবেশী দুই দেশ জাম্বিয়া এবং জিম্বাবুয়ের মধ্যে আছে দারুণ সম্পর্ক। এ যেন একই বৃন্তে দুটি কুসুম, যেনবা এক মায়ের দুই জমজ সন্তান।
১৯৬৪ সালের পূর্বে এই দুই দেশের মিলিত নাম ছিল রোডেশিয়া। স্বাধীনতা লাভের পর দুই দেশের পৃথক দুটি নাম হয়েছে জিম্বাবুয়ে আর জাম্বিয়া। পৃথিবীর প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্যের মধ্যে অন্যতম একটি ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত।
আফ্রিকা মহাদেশের এই দুটি দেশ জাম্বিয়া ও জিম্বাবুয়ের সীমানায় অবস্থিত এই জলপ্রপাত পৃথিবীর দীর্ঘতম জলপ্রপাত। রানী ভিক্টোরিয়ার নামে এর নামকরণ করেন অভিযাত্রী ডেভিড লিভিংস্টোন। কিন্তু স্থানীয়রা এটিকে ‘মসি ওয়া তুনইয়া’ নামে ডাকে। যার অর্থ হচ্ছে ‘যে ধোঁয়া বজ্রধ্বনি করে’।
১০৮ মিটার গভীর জলপ্রপাতটি এমন কুয়াশার সৃষ্টি করে, যা ২০ কি.মি দূর থেকে দেখা যায়। এটি উচ্চতায় ১০৮.৩ মিটার এবং প্রস্থে এক হাজার ৭০৩ মিটার।
প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৩৩ হাজার ঘনফুট (৯৩৫ ঘনমিটার) জল পতিত হয়। নায়াগ্রা জলপ্রপাতের সঙ্গে তুলনা করলে ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত প্রায় দ্বিগুণ প্রশস্ত ও দ্বিগুণ গভীর।
ইউনেস্কো ১৯৮৯ সালে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে জলপ্রপাতটিকে উভয় নামেই তালিকাভুক্ত করে। জলপ্রপাতের উভয় অংশকে সংযুক্ত করতে ভিক্টোরিয়া ফলস (জাম্বেজি) সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে রেলগাড়ি ও মোটরগাড়ি চলাচল করে। বর্তমানে এটি বহির্বিশ্বের পর্যটকদের কাছে প্রধান আকর্ষণ। আশি ভাগ জিম্বাবুয়েতে থাকলেও বিশ ভাগের জাম্বিয়ার গুরুত্ব একেবারেই কম না। পর্যটকদের দারুণ পছন্দ হারারের মতো যেমন লুসাকাও, তেমনই এই জলপ্রপাতও।
জাম্বিয়ার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি এখানে আছে নিজেদের তৈরি এক বিশাল লেক। যে লেকটি দেখে মনেই হয় না মানুষের বানানো। চারদিকে সবুজ পাহাড়, তাঁর বুকে একেবেকে নীলাভ জলের অঞ্চল।
পর্যটকদের নিয়ে সেই নীল জলে ছুটে চলছে সাদা সাদা জাহাজ। কারিবা নামের এই লেকে দেখতে পাওয়া যায় হরেক প্রজাতির রঙিন মাছের মেলা। একবার সেখানে গেলে ফিরতে মন চায় না। আর পুরোটা ঘুরে দেখার জন্য সেখানে আছে স্পিড বোটের ব্যবস্থাও।
আফ্রিকা মহাদেশের মানুষের তো বিচিত্র সব কৃষ্টি কালচার। সেদিক দিয়ে জাম্বিয়ার মানুষেরা দারুণ সব রীতিতে বিশ্বাসী। আপনি তাদের অতিথি হয়ে যাবেন, দাঁড়িয়ে থাকবেন। ততক্ষণ পর্যন্ত বসতে দেবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত আপনার জন্য বরাদ্দ চেয়ারটি ধুয়ে মুছে পরিষ্কার না হয়ে যাবে। আবার সকলে মিলে খেতে বসতে হবে।
যতই দেরি হোক, প্রত্যেকে একত্রে বসেছে কি না, তা নিশ্চিত হবার পর খেতে আরম্ভ করে এই দেশের পরিবারের লোকজন। আর দুই হাতে খাওয়া যাবে না। এক হাতে খেতে হবে। খাওয়ার খুব স্বাদ হয়েছে? প্রশংসা করা যাবে না, বড়জোর ধন্যবাদ দেয়া যাবে। প্রশংসা শুনলে তারা লজ্জা পান। খাবার শেষ হবার আগে অল্প খাবার রেখে দিতে হবে থালার এক কোণে। এটুকু কাজের ছেলে বা মেয়ের জন্য বরাদ্দ।
আপনি যা দিয়ে খেলেন, সেই একই খাবার তার জন্যও রেখে দিতে হবে। এই দেশের মানুষেরা প্রয়োজনের বাইরে কথা বলে না। জীবন যাপন এত সুন্দর বলেই আফ্রিকার সব দেশে হাজারে হাজার এইডস রোগী পাওয়া গেলেও জাম্বিয়ায় একজনও পাওয়া যায়নি।
জাম্বিয়ায় ইসলামের আবির্ভাব হিজরি চতুর্থ শতাব্দীতে, যখন পূর্ব আফ্রিকায় মুসলিম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। আর প্রসার ঘটে আরও অনেক পরে। ব্রিটিশ শাসনামলে অনেক মুসলিম ভারতবর্ষ থেকে জাম্বিয়া গিয়েছিল দেশটিতে রেলপথ নির্মাণে অংশ নিতে।
এক সময়ের খৃষ্টান অধ্যুষিত দেশের এখন পঁচানব্বই ভাগ মুসলিম। দুই হাজার পনের সালে জাম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট ইয়াহইয়া জামেহ জাম্বিয়াকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করে। জাম্বিয়ার মসজিদগুলো তাদের বাড়িঘরের চেয়েও সুন্দর ও অধিক দৃষ্টিনন্দন। ছবি ও তথ্য সহায়তা – ইন্টারনেট