বাঙালির হাজার বছরের হারানো ঐতিহ্যের অনুসন্ধানী মুন্সী আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ প্রাচীন সাহিত্যের সংগ্রাহক ও আবিস্কর্তা ছিলেন। তিনি তার আবিস্কৃত প্রাচীন নিদর্শন পান্ডুলিপি থেকে যে কৌশলে তথ্য বের করে নিতে যে শ্রমসাধ্য মনোযোগী হতেন তা ছিল এক বিস্ময়কর জ্ঞান আহরণ দৃশ্য। তাই তার উদ্ধারকৃত পান্ডুলিপি এবং গবেষণামূলক রচনাসমূহ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অনন্য দুর্বভ সম্পদ হিসেবে আলোচ্য বিষয়।
আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ ১৮৭১ সালের ১০ অক্টোবর এক প্রাচীন সম্ভ্রান্ত মুন্সী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামের নাম সুচক্রদন্ডী, পটিয়া, চট্টগ্রাম। এ ঐতিহ্যবাহী গ্রামে বহু খ্যাতমানা সুপুরুষের জন্ম। তার পিতার নাম মুন্সী নুরুদ্দিন (১৮৩৮-১৮৭১) এবং মাতা মিশ্রীজান ছিলেন পটিয়ার গ্রামের প্রাচীন প্রখ্যাত পাঠান তরফদার দৌলত হামজা বংশের মেয়ে। এ রত্নাগর্ভা মহিলার পিতামহ ফকির কামদর আলী চৌধুরী একজন আধ্যাত্মিক পুরুষ ছিলেন।
শিশু আবদুল করিম জন্মের তিন পূর্বে পিতাকে হারান। সতেরো বছর বয়সে ১৮৮৮ সালে স্নেহময়ী মাকেও হারান। তিনি ছ’বছর বয়সে শিক্ষায় হাতেখড়ি হন। তিনি পারিবারিক কাছারী ঘরে গৃহ শিক্ষকের হাতে বাংলা, ইংরেজি ও আরবি শিক্ষা প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করেন। ১৮৮২ সালে গ্রামের স্কুল সুচক্রদন্ডী মধ্যবঙ্গ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এখানে অধ্যয়নকালে পারিবারিক কারণে তাকে বিয়ের পিড়িতে বসতে হয়েছে। তার বিয়ে হয় আপন চাচাতো বোন নয় বছর বয়স্ক বদিউন্নেছার সঙ্গে। ১৮৮৩ সালে কিশোর আবদুল করিম পটিয়া ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এখানে অধ্যয়নকালে ক্রমে তিনি সাহিত্যের প্রতি কৌতুহলী হয়ে উঠেন। তিনি যখন নবম শ্রেণির সে সময়ে তাঁর সহপাঠী দু’জন হিন্দু ছাত্র মাসিক ‘অনুসন্ধান’ পত্রিকার গ্রাহক ছিলেন। তাদের সঙ্গে তিনিও পাঠক হয়ে উঠেন। এ সাথে ক্রমে তিনি গ্রাহক হতে থাকেন ‘হোপ’ নামের সাপ্তাহিক ইংরেজি পত্রিকাও ‘প্রকৃতি’ নামের সাপ্তাহিক বাংলা সাময়িকী। শিক্ষাজীবনে আরো আটখানা সাময়িকীর গ্রাহক হন।
মুন্সী আবদুল করিম যথাসময়ে ১৮৯৩ সালে পটিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় বিভাগে এন্ট্রাস পাস করেন। তার দ্বিতীয় ভাষা ছিল সংস্কৃত। এ সংস্কৃত জ্ঞান পরবর্তী জীবনে বিশেষ সহায়ক হয়ে উঠে। তার পাসের খবর শুনে দূর-দূরান্ত থেকে মুসলমানেরা তাকে দেখতে আসছিলেন।
ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লার মতে, সম্ভবত গোটা বাংলাদেশ আধুনিক যুগে তিনিই প্রথম সংস্কৃত পড়–য়া মুসলমান ছাত্র। এ কীর্তিমান ছাত্র আবদুল করিম একই সনে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে এফ এ (আই এ) শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৮৯৪ সালে তিনি এফ এ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। এ সময় তার নজরে আসে কতেক পদাবলীর পান্ডুলিপি। তিনি কিছুদিন এ সব নাড়াচাড়া করে বুঝতে পারলেন এ জাতীয় পদাবলী বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা, পূর্ণিমা প্রভৃতি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে আসছে। তিনি ক্রমে এ দুলর্ভ পদগুলোকে ‘অপ্রকাশিত পদাবলী’ নাম দিয়ে এক এক পর্ব করে ‘পূর্ণিমা’য় পাঠাতেন। আর পত্রিকা সম্পাদক ছাপিয়ে দিয়ে সংকলককে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সুবাদে তিনি কবি নবীন চন্দ্রসেনের সঙ্গে গভীর পরিচয় গড়ে তোলেন।
করিম সাহেব কলেজে দু’বছর অধ্যয়নের পর শেষ পরীক্ষার সময় হঠাৎ তিনি ‘টাইফয়েড রোগে’ আক্রান্ত হয়ে পড়েন। ফলে তিনি আর উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ না করে শিক্ষকতায় জড়িয়ে পড়েন। যোগ দিলেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন স্কুলে। কিছুকাল পর সীতাকুন্ড স্কুলে। পরে জর্জকোর্টে নকল নবীশপদে যোগদান। এ সময় পটিয়ার কালী শংকর চক্রবর্তী সম্পাদিত ‘সাপ্তাহিক জ্যোতি’ পত্রিকায় পুঁথি সংগ্রহ বিষয় নিযে বিজ্ঞপ্তি দেয়ার কারণে যড়যন্ত্রের জালে পড়ে চাকরি হারান। ফলে তিনি পুনরায় আনোয়ারা স্কুলে প্রধান শিক্ষকের পদে যোগ দেন। এখানে তিনি একটানা ছ’বছর (১৮৯৯-১৯০৫) শিক্ষকতা করেন। তার ভাষায় বলা যায়, ‘আমার জীবনে স্বর্ণময় যুগ হলো আনোয়ারায় শিক্ষকতা জীবন। কারণ এখানেই আমি প্রথম আবিস্কার করি মহাকবি শেখ আলাওল বিরচিত ‘পদ্মাবর্তী’। অনুসন্ধানে জানা যায়, তিনি পদ্মাবর্তী কাব্যের ৩৯ খানা পান্ডুলিপি সংগ্রহ করেন। এ সবের মধ্যে সর্বপ্রাচীন পান্ডুলিপিখানার লিপিকালের তারিখ ১৭৪৭ খৃঃ।
বিশারদ সাহেব এ তথ্য পেয়ে মনে মনে ভাবতে শুরু করেন নিশ্চয় এ পুঁথির রচনাকাল আরো শতেক কাল পূর্বে হবে। এছাড়া আরো একটি তথ্য তাঁর ভাবনায় কাজ করতে সাহায্য করছে, তা হচ্ছে পদ্মাবতীর নবাবিষ্কুত পান্ডুলিপিতে পুঁথির মালিকের নাম পরিচয় পাওয়া যায় একজন ঐতিহাসিক বাতিঘর। তিনি হচ্ছেন ‘শ্রীযুক্ত জবরদস্ত খা চৌধুরী ওয়ালাদে রুস্তম খা চৌধুরী’।
এ জবরদস্ত খা ছিলেন চট্টগ্রামের ফৌজদার নবাব ইয়াছিন খানের সমসাময়িক এবং তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। নবাবীর সময়কাল ১৭২৩-২৪। বিশারদ সাহেব এ সব দিক চিন্তা ভাবনা করে সঠিক সিদ্ধান্তে এসে মত প্রকাশ করেন।
আলাওলকে সুধীসমাজ এ পর্যন্ত ঊনিশ শতকের কবি বলে যেভাবে প্রচার করে আসছেন, তা তো ঠিক নয়। তিনি যে সপ্তদশ শথকের মাঝামাঝি সময়ের কবি, তাতে সন্দেহ করার কি আছে? তিনি তার আবিষ্কুত পান্ডুলিপি কয়েক মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ পাঠ শেষ করে যে সব তথ্য পান এর ভিত্তিতে রচনা করেন ‘কবির সৈয়দ আলাওল সাহেব’ এবং এটি প্রকাশিত হয় ‘পূর্ণিমা’ ফাল্গুন-চৈত্র ১৯৯৯। এ আবিস্কার ও প্রবন্ধ প্রকাশ তাকে প্রাচীন সাহিত্য চর্চা ও আবিষ্কারের নেশা বহুগুণ এগিয়ে দিয়েছে।
এরপর তিন একের পর এক আবিষ্কার করতে থাকেন-শাহ মুহাম্মদ সগীর বিরচিত ‘ইউসুফ জুলেখা; শেখ শাহ দ্বৈনিন্দন বিরচিত ‘ব্যঙ্গনামা’, সৈয়দ সুলতান বিরচিত নবী বংশ, শেখ মীর ফয়জুল্লাহ বিরতি ‘গোরক্ষ বিজয়, দৌলত উজির বাহরাম খা বিরচিত ‘লাইলী মজনু’, কাজী দৌলত ও আলাওল বিরচিত ‘সতীময়না ও লোড়চন্দ্রানী, শেখ মোজাম্মেল বিরচিত ‘নীতি শাস্ত্র বার্তা’, মুহাম্মদ মনির বিরচিত ‘মধুমালতী’, শাবারিদ খা বিরচিত বিদ্যাসুন্দর প্রভৃতি কবি ও কাব্য আবিষ্কার করে জাতিকে দেখায়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টি ও চর্চার মূলে হিন্দু-মুলমানের মন-মানসিকতার পরিচয় দিল। এভাবে তিনি মধ্যযুগের একটি পর্বকে উদ্ধার করে মহাকালের আবিষ্ককর্তার গৌরব অর্জন করেন। এ কারণে তাকে বাংলা সাহিত্যের কলম্বাস বলেও সাহিত্যের পন্ডিতমন্ডলী জ্ঞান করেন। মাত্র পনের বছরের অসাধারণ সাহিত্যকর্ম দেখে তিনি জাতীয়ভাবে খেতাব লাভ করেন।
যেমন ১৯০৯ সনে নদীয়ার ‘সাহিত্য সভা’ তাকে সাহিত্য সাগর এবং বিশ বছরের মাথায় ১৯১৭ সনে ‘চট্টল ধর্মমন্ডলী’ সাহিত্য বিশারদ উপাধি দিয়ে উৎসাহিত করেন। অবশ্য তিনি পরবর্তী উপাধিটি সারাজীবন ব্যবহার করেছেন। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ তাকে ‘ফেলো’ সদস্য ও উক্ত প্রতিষ্ঠানের সহ-সভাপতির মত গৌরবময় পদে অভিষ্টি। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম কুমিল্লা ও কলকাতায় তিনি দশটি জাতীয় পর্যায়ের সাহিত্য, সংস্কৃতি বিষয়ক সম্মেলনে সভাপতি পদ অলংকৃত করে বিপুল জনতার শ্রদ্ধা লাভ করেছিলেন। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ তার মৃত্যুতে শোকসভার আয়োজন করে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। ১৯৪৬ সালে চট্টগ্রামবাসী তার জন্মজয়ন্ত আয়োজন করে সংবর্ধনা জানিয়েছিলেন।
সাহিত্য বিশারদের সাহিত্য সাধনার প্রধান দু’টি দিক হচ্ছে একটি সংগ্রহ ও অপরটি গবেষণা। সংগ্রহ কর্মে তিনি তার মামাতু ভ্রাতুষ্পুত্র শিক্ষক আবদুস সাত্তার চৌধুরীকে দীক্ষা দিয়ে পুঁথি সংগ্রহে উৎসাহ যোগায়েছিলেন। তার সেই সুযোগ্য শিষ্য সাত্তার চৌধুরী পরবর্তী ষাট-সত্তর দশকে বাংলা একাডেমি, জাতীয় যাদুঘর, এশিয়াটিক সোসাইটি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি জাতীয় প্রতিষ্ঠানের প্রায় দু’হাজার বিভিন্ন ভাষা লেখা প্রাচীন পান্ডুলিপি জমা দেন। সে সবের মধ্যে বেশ ক’টি নবাবিস্কৃত কবি ও কাব্যও রয়েছে। এদিক দিয়ে মরহুম সাত্তার চৌধুরী দীক্ষা গুরু বিশারদ সাহেবের সংগ্রহ ভুবনে সফলতা লাভে অমর হয়ে আছেন।
বিশারদ সাহেবের দ্বিতীয় দিকটি হলো সংগ্রহ ও সংরক্ষিত পুঁথি নিয়ে গবেষণা ও প্রকাশনা। এ কাজে তিনি ব্রতী করায়ে যান ভ্রাতুষ্পুত্র (যিনি পুত্রতল্য) ড. আহমদ শরীফকে। পরবর্তীকালে দেখা গেল বাংলাদেশে যে সব গবেষক মধ্যযুগের সাহিত্যকর্ম নিয়ে কাজ করেছেন তাদের মধ্যে ড. আহমদ শরীফ সাহেবই প্রধান পুরুষ। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহের পদ্মাবর্তীর কথা বাদ দিলেই তিনিই প্রথম পুঁথি সম্পাদক। ১৬৫৬ সালে তার সম্পাদিত লাইলী মজনু প্রকাশিত হয়। এভাবে পুঁথি পরিচিতি, প্রভৃতি বহুগ্রন্থ সম্পাদনা করেন। এ বিষয়ে তার প্রধান ও সবকর্ম গ্রন্থ বাঙালি ও বাংলা সাহিত্য ১ম খন্ড ও দ্বিতীয় খন্ড (দু’টি মিলে প্রায় দু’হাজার পৃষ্ঠা) তার সম্পাদিত পুঁথির সংখা প্রায় অর্ধশত।
কবি গুরু রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর ১৯০৭ সালে চট্টগ্রাম সফরকালে বিশারদ সাহেবের সাক্ষাৎ হয়। আলাপ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে আহবান জানায়ে বলেন, আপনি পুঁথি সাহিত্য চর্চার ভেতর দিয়ে জাতি বড় খেতমত করছেন। তা ভাল, তবে এ সাথে লোক সাহিত্যের ছড়া, ধাঁধাঁ, প্রবাদ সংগ্রহ করে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ পত্রিকায় পাঠান; তাতে লোক সাহিত্যের চর্চার উন্নতি হবে।
তার এ আহব্বানে তিনি সংগ্রহ করলেন প্রায় ২৫০টি ছড়া, ধাঁধাঁ ও প্রবাদ। ড. আবদুল করিম বলেন, ‘বিশারদ সাহেব তার সুদীর্ঘকালের নিরলস দ্বারা একই কীর্তি প্রতিষ্ঠান। এ মহান অমর পুরুষ এমনি একটি দিনে (৩০-৯-১৯৫৩) ফজরের নামাজ শেষে জাতীয় গাথা কাহিনি রচনা করতে করতে (বুধবার) সকাল দশটায় পরপারে যাত্রা করেন।